ইন্সুরেন্স কি হালাল | ইসলামিক দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স-বীমা

আসসালামু আলাইকুম

আজকের এই পোষ্টে আমরা ইন্সুরেন্স / বীমা কি হালাল না হারাম, ইসলামিক দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স-বীমা এর বিধান নিয়ে আলোচনা করবো।

ইন্সুরেন্স / বীমার পরিচয়

বীমা শব্দটি মুলত একটি উর্দু শব্দ। এর ইংরেজি হলো insurance. এটা Ensurance শব্দটি থেকে উৎপত্তি হয়েছে। ইন্সুরেন্স / বীমা এর অর্থ হচ্ছে: নিশ্চয়তা প্রদান করা। আর ইন্সুরেন্স এর আরবী হলো عقد التامين.

তাত্ত্বিক ভাবে বীমা বা ইন্সুরেন্স হলো “ভবিষ্যতে অনিশ্চিত কোনো ক্ষতির বা দুর্ঘটনার বিপরীতে নির্দিষ্ট কিছু টাকা (প্রিমিয়াম) ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিশোধ করা”

এক কথায়, ইন্সুরেন্সএমন একটি আর্থিক লেনদেনের চুক্তি, যার ফলে ভবিষ্যতে কোনো দুর্ঘটনা সংঘটিত হলে তার ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দিষ্টতার ভিত্তিতে কিস্তিতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টাকা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

ইন্সুরেন্স কি হালাল
ইন্সুরেন্স কি হালাল | ইসলামিক দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স-বীমা

ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স বা বীমা করা কি হালাল ?

ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স বা বীমা করা কি হালাল??? না, শরীয়তের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স বা বীমা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম একটি লেনদেন। ওআইসির শাখা সংস্থা “আর্ন্তজাতিক ফিকহ একাডেমি” এবং সৌদীআরবের প্রখ্যাত ধর্মীয় সংস্থা “উচ্চ উলামা পরিষদ” সহ বিশ্বের সকল নির্ভরযোগ্য  প্রতিষ্ঠান ও বেশিরভাগ ফকীহ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সব ধরণের বানিজ্য বীমাই নাজায়েজ ও হারাম।

তা হোক সম্পদের বীমা বা জীবনের বীমা। উলামায়ে কিরাম এরজন্য একাধিক কারণ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার মধ্য হতে এখানে কয়েকটি উল্লেখ করেছি-

আরো পড়ুনঃ   সরকারি ছুটির তালিকা ২০২৩ | বাংলা ক্যালেন্ডার | Bangladesh govt holiday 2023

ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স / বীমা

এতে প্রত্যক্ষভাবে সুদ পাওয়া যায়। যেহেতু এতে যে পরিমাণ অর্থ জমা দেয়া হয় তার বিনিময়ে তার চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণ করা হয়। আর ইসলামি শরীয়তের পরিভায়ায় সরাসরি আর্থিক লেনদেনের মাঝে  কমবেশি মুনাফা চুক্তিকেই তো সুদ বলা হয়। পবিত্র কোরআনুল কারীমের মধ্যে আল্লাহ তায়ারা পরিষ্কার ভাবে সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন,

وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا

অর্থ: ‘আর আল্লাহ তায়ালা ক্রয়-বিক্রয় অর্থাৎ ব্যাবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন।’ (সূরা বাকারাহ ; আয়াত-২৭৫)

ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স / বীমা

এর মাঝে ধোকা ও ঝুঁকি বিদ্যমান রয়েছে। যেহেতু বীমাকারীর একথা নির্দিষ্টভাবে জানা নেই যে, সে কী পরিমাণ টাকা/অর্থ জমা দিবে আর কী পরিমাণ টাকা গ্রহণ করবে?

এমনও হতে পারে যে, বীমাকারী ইন্সুরেন্স করার কিছুদিনের মধ্যেই সে দুর্ঘটনায় পতিত হলো। তখন ইন্সুরেন্স/বীমা প্রতিষ্ঠান তার চুক্তির শর্তানুযায়ী অনেক বড় অংকের অর্থ দিতে বাধ্য হবে।

আবার এমনও হতে পারে যে, সারাজীবন বীমাকারীর কোনো দুর্ঘটনাই সংঘটিত হলো না। তাহলে এক্ষেত্রে ইন্সুরেন্সকারীকে সকল কিস্তি পরিশোধ করিতে হবে। অথচ ইন্সুরেন্সকারী জীবিত অবস্থায় এর থেকে কিছুই পাবে না; বরং ইন্সুরেন্সকারী মৃত্যুর পর তার ওয়ারিশরা এর লাভ পাবে। হাদীসে এ ব্যাপারে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ بَيْعِ الْحَصَاةِ وَعَنْ بَيْعِ الْغَرَرِ.

অর্থ: ‘রাসূল (সা) পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে (আরবে প্রদেশে প্রচলিত এক ধরণের বিশেষ ক্রয়বিক্রয় পদ্ধতি) ও প্রতারণামূলক লেনদেন থেকে নিষেধ করেছেন।’ (সহীহ মুসলিম: হাদীস নাম্বর-৩৮৮১)

ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স / বীমা

ইনসুরেন্স / বীমায় জুয়া বিদ্যমান। যেহেতু বীমা/ইন্সুরেন্স গ্রহনকারী কখন মারা যাবে, আর সে কতো টাকা পাবে তার কোনোই নিশ্চয়তা নেই। আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় যেকোনোঅনিশ্চিত লেনদেনকেই জুয়া বলে।  

আল্লাহ তায়ালা জুয়াকে শয়তানের কাজকর্ম বলে অভিহিত করেছেন এবং জুয়া থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছেন।  তিনি বলেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

অর্থঃ ‘হে মুমিনগণ, মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ এসবই শয়তানের কার্য বৈ কিছু নয়।  অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাকো, যেনো তোমরা সফলকাম হও। ‘ (সূরা মায়েদা; আয়াত- ৯০)

ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স / বীমা

ইনসুরেন্স / বীমাতে  যুলুম পাওয়া যায়। যেহেতু এই বীমাকারী প্রয়োজনবশতঃ হলেও যদি কিস্তি দিতে অপারগ হওয়ায় এটা বাতিল করতে চায় তাহলে ইনসুরেন্স / বীমা প্রতিষ্ঠান তার সমুদয় অর্থ রেখে দেয়, যা সুস্পষ্টরুপে যুলুম ও অমানবিক।  আল্লাহ তায়ালা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ

অর্থঃ ‘হে মুমিনগণ, তোমরা এক অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।’ (সূরা নিসা; আয়াত- ২৯)

আরো পড়ুনঃ   নফল রোজার নিয়ত ও ফজিলত

ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স / বীমা

এখানে মানুষকে বিক্রয়লদ্ধ পণ্য হিসেবে বিচার বিবেচনা করা হয়।  যেহেতেু এখানে মানুষের সাথে সংগঠিত মৃত্যু বা দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে চুক্তি করা হয়, তাই এখানে মানুষকে একধরনের পণ্য হিসেবে মূল্যায়িত করা হয়ে থাকে। অথচ মানুষ সবচেয়ে সম্মান ও মর্যাদাসম্পন্ন এক জাতি, যা ক্রমেই বিক্রয়যোগ্য হতেই পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا

অর্থঃ নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (সূরা বনী ইসরাইল আয়াত-৭০)।

এছাড়াও আরো অনেক অনেক কারণ আছে, যার জন্য উলামায়ে কিরাম সর্বসম্মতভাবে সকল ধরনের ইনসুরেন্স / বীমাকে নাজায়েয ও হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছেন। মূল কথা হলো, মানুয়ের সকল রিযিকের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর তায়ালার হাতে।

এই কথার উপর সকল মুমিনের মুসলমানের বিশ্বাস রাখা খুবই জরুরি। এর বিপরীতে লাইফ ইন্সুরেন্সের দ্বারা মৃত্যুর পরবর্তীতে পরিবার খুব ভালোভাবে চলতে পারবে এই বিশ্বাস অন্তরে লালন পালন করে যাওয়া শুধু গোনাহই না; বরং এটি শিরকের অর্ন্তভুক্ত।  তাই এর থেকে সবার বেচেঁ থাকা একান্তভাবে জরুরি।

কেউ ইনসুরেন্স / বীমা করে ফেললে এখন তার করণীয়

ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইন্সুরেন্স / বীমায় কেউ জড়িয়ে পড়ার পরে নিজের ভুল বুঝতে পারলে আল্লাহর কাছে খালেস দিলে তওবাহ করে সাথে সাথে তার এই ইন্সুরেন্স / বীমা কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। সম্ভব হলে তাৎক্ষনাতভাবে তার জমাকৃত অর্থ/টাকা তুলে ফেলবে।

একান্তভাবে তুলতে সক্ষম না হলে যখন ইন্সুরেন্স/বীমা প্রতিষ্ঠান তাকে সম্পুর্ন টাকা প্রদান করবে তখন শুধু নিজের আসল জমাকৃত টাকা রেখে বাকী লাভ গরীবদের মাঝে দান করে দিবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে সুদ থেকে মুক্ত থাকার তৌফিক দান করুন।

আরো পড়ুনঃ কোরবানি সম্পর্কে কোরআনের আয়াত ও হাদিস

রেফারেন্স

  • আহকামুল কুরআন, জাসসাস : ২/১১
  • তাফসীরে তাবারী: ১৬/৭৩, হা. ইং ২১৩১৪
  • রদ্দুল মহতার : ৫/৬৯৬
  • ফাতাওয়ায়ে উসমানী : ৩/৩১৪
  • কিতাবুল ফাতাওয়া: ৪/৬৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *